উচ্চরক্তচাপ কি ?
হাইপারটেনশন (ইংরেজি: Hypertension), যার আরেক নাম উচ্চ রক্তচাপ, HTN , বা HPN, হল একটি রোগ যখন কোন ব্যাক্তির রক্তের চাপ সব সময়েই স্বাভাবিকের চেয়ে উর্ধ্বে। হাইপারটেনশনকে প্রাথমিক (আবশ্যিক) হাইপারটেনশন অথবা গৌণ হাইপারটেনশনে শ্রেণীভুক্ত করা হয়। প্রায় ৯০–৯৫% ভাগ হ্মেত্রেই “প্রাথমিক হাইপারটেনশন” বলে চিহ্নিত করা হয়। উচ্চ রক্ত চাপের কোন উল্লেখ যোগ্য কারণ কোনও চিকিৎসা-শাস্ত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শ্রেণীবিভাগ
কোনও সুনির্দিষ্ট বিন্দু নেই যখন রক্ত চাপ বিবেচনা করা হয় “উচ্চ”। বলা হয় সাধারনভাবে, যদি কোনও একজনের রক্ত চাপ ১৪০/৯০ টর অথবা উপরে থাকে (চাপের একটি একক) উভয় বাহুতে, তাহলে তার উচ্চ রক্ত চাপ বলা যেতে পারে। একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের হিসেবে ১৩৯/৮৯ টর রক্ত চাপ থেকে ১২০/৮০ টর সংজ্ঞায়িত করেছে “প্রিহাইপারটেনশন”। প্রিহাইপারটেনশন একটি রোগ নয়, কিন্তু আশঙ্কা করে যে একটি ব্যক্তির উচ্চরক্তচাপে বিকশিত করার একটি যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ডায়াবেটিস মেলিটাস অথবা কিডনী রোগীদের ক্ষেত্রে গবেষনায় দেখা গেছে, ১৩০/৮০ টরের অধিক রক্তচাকে ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা উচিৎ এবং এর তারাতারি চিকিৎসা হওয়া উচিৎ।
কারণ
যে সকল কারণ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে সেগুলো হল: বেশী লবন গ্রহণ, অতিরিক্ত মেদ, কাজের আপ, মদ্যপান, পরিবারের আকার, অতিরিক্ত আওয়াজ এবং ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকা। উচ্চময়াত্রার লবনের ব্যাবহার এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী মনযোগ আকর্ষণ করেছে। ধারণা করা হয় প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ রোগী লবনের ব্যাবহার দ্বারা প্রভাবিত হন।
উচ্চরক্তচাপ সর্বাপেক্ষা সাধারণ জটিল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অসুস্থতার একটি। এখন পর্যন্ত ৫০ টির অধিক জিনকে চিহ্নিত করা হয়েছে উচ্চ রক্তচাপের গবেষনার জন্য এবং এই সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। বৃক্কের উচ্চরক্তচাপ বৃক্কজনিত অসুস্থতার কারণে ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে যা হয় তা হল , বৃক্কের কলাসমূহের মাঝে রক্তসঞ্চালন কমিয়ে দেয়, কারণ রেনেন-এনজিওটেন্সেন সিস্টেমের প্রধান অথবা শাখা ধমনী সমূহ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে।
যদিও উচ্চ রক্তচাপ আলাদাভাবে কোন অসুস্থতা নয়, কিন্তু প্রায়ই এর চিকিৎসা প্রয়োজন হয় কারণ শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ওপর এর স্বল্প থেকে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে। বিশেষত স্ট্রোক, হার্ট ফেইলিউর, হৃদক্রিয়া বন্ধ, চোখের ক্ষতি এবং বৃক্কের বিকলতা ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
যদিও খুব সামান্য গর্ভবতী মহিলাই উচ্চ রক্তচাপ অনুভব করেন, কিন্তু শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত গর্ভধারণের কারণে উচ্চ রক্তচাপের স্বীকার হন।
নির্ণয়
হাইপারটেনশনের অবস্থা নির্ণয়ের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশী হলে ধরে নেয়া হয়। স্বাধারণত এক সপ্তাহের বিরতিতে কমপক্ষে তিনবার মাপা লাগে। সঠিক চাপ মাপার জন্য কয়েকটি নিয়ম মানা জরুরী এবং অন্যান্য যেসকল বিষয় রক্তচাপকে প্রভাবিত করে সেগুলোও বিবেচনা করা প্রয়োজন। যেমন, রক্তচাপ মাপার কমপক্ষে আধা ঘন্টা আগে থেকে ধুমপান থেকে বিরত থাকতে হবে এবং ক্যাফেইন গ্রহণের কমপক্ষে একঘন্টা পরে মাপা লাগবে, দুশ্চিন্তামুক্ত অবস্থায় মাপা জরুরী। আস্তিনের আকারও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আস্তিনের ঘুরে যাওয়া উচিৎ এবং ওপরের বাহুর দুই তৃতীয়াংশ ঘিরে ফেলা উচিৎ। কমপক্ষে পাঁচ মিনিট সময় বসা অবস্থায় থাকা উচিৎ।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ
অনেকের শুরুতে রক্তচাপে কোনো উপসর্গ থাকে না। রুটিন চেকআপে বা অন্য কোনো কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে যেমন
*মাথাব্যথা, মাথার পেছন দিকে ব্যথা হতে পারে, সকালবেলা এবং হাঁটার সময় ব্যথার তীব্রতা বাড়ে। কারও কারও ক্ষেত্রে মাথা গরম অনুভূত হতে পারে।
*ঘুমের ব্যাঘাত হওয়া।
*বুকে চাপ অনুভব হওয়া।
* বুক ধড়ফড় করা।
*চোখের দৃষ্টিতে অসুবিধা বা ঝাপসা লাগা।
*সব সময় খিটখিটে মেজাজ থাকা।
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে করণীয়
*জীবনযাত্রার পরিবর্তন এনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
*অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে
*খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা: কম চর্বি ও কম কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে।
*লবণ নিয়ন্ত্রণ: খাবারে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
*নিয়মিত ব্যায়াম: সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি।
* ধূমপান বাদ দিতে হবে।
*ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
*মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে।
চিকিৎসা
মৃদু থেকে মাঝারি ধরণের রক্তচাপের জন্য চিকিৎসকেরা ওজন কমানো এবং নিয়মিত ব্যায়ামকে চিকিৎসার প্রথম ধাপ হিসেবে ধরেন। যদিও এই পদ্ধতিগুলি রক্তচাপ কমানোর জন্য অত্যান্ত ফলপ্রসু, কিন্তু এইগুলি বলার চেয়ে করা প্রকৃতপক্ষে সহজ ন্য। বেশীরভাগ রুগীই মাঝারী থেকে উচ্চ রক্তচাপে যারা ভূগছেন, তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ঔষধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তাদের রক্তচাপ নিরাপদ মাত্রায় নিয়ে আসার জন্য। যদিও ধূমপান ছেড়ে দেয়া সরাসরি রক্তচাপ কমায় না, কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের সাথে এটি অত্যান্ত্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের বেশকিছু উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে আসে যেমন স্ট্রোক অথবা হার্ট এটাক। মৃদু উচ্চরক্তচাপ সাধারণত খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম এবং শারিরীক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। ফল, শাক সব্জি, স্নেহ বিহীনদুগ্ধজাত খাদ্য এবং নিম্নমাত্রার লবন ও তেলের খাদ্য উচ্চ রক্তচাপ বিশিষ্ট রোগীর রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম রক্ত চলাচলের উন্নতি করে, এবং রক্তচাপ কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও পরিবেশগত চাপ যেমন উঁচু মাত্রার শব্দের পরিবেশ বা অতিরিক্ত আলো পরিহার করাও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী হতে পারে।
বাজারে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু রকমের ঔষধের ব্যাবস্থা রয়েছে যেগুলো অন্তিহ্য়্পের্তেন্সিভেস নামে পরিচিত। যা রক্তচাপ কমিয়ে আনে। রক্তচাপ ৫-৬ টর কমালে তা স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রায় ৪০%, করোনারী হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ১৫-২০% কমিয়ে আনে এবং হার্ট ফেইলিউরের সম্ভাবনাও কমে আসে। সাধারণভাবে প্রচলিত ঔষধসমূহের মধ্যে রয়েছে, বেটা ব্লকার যেমনঃ metoprolol, atenolol, labetalol এসিই নিরোধক যেমনঃ lisinopril, quinapril, fosinopril এনজিওটেসটিন রিসিপটর ব্লকার (এআরবি) যেমনঃ losartan, valsartan ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার যেমনঃ amlodipine, verapamil; ডিউরেটিকস, যেমন chlortalidone, hydrochlorothiazide (এইচসিটিজেট), মিশ্র ঔষধ (সাধারণত এইচসিটিজেট এবং অন্য একটি ঔষধ একত্রে), এবং আলফা ব্লকার্স যেমন terazosin এবং prazosin.
চিকিৎসার মূল লক্ষ হওয়া উচিৎ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ১৪০/৯০ টরের নিচে আর কিছু ক্ষেত্রে আরো নিচে নিয়ে আসা যেমন ডায়বেটিস বা কিডনীর রুগীদের ক্ষেত্রে। প্রতিটি ঔষধ আলাদাভাবে সিস্টোলিক চাপ ৫-১০ টর কমিয়ে নিতে পারে। তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক ঔষধের প্রয়োজন হয়।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন
এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দুশ্চিন্তাহীন জীবনযাপন করতে হবে। ওজন কমাতে হবে, ছোট মাছ, শাকসবজি ও ফলমূল বেশি খেতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে এবং ডায়াবেটিস থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ওষুধপথ্য সেবন করতে হবে। কোনোক্রমেই চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। অনেকেই আবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন। কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে উচ্চ রক্তচাপ তাঁর দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোনো সমস্যা করছে না বা রোগের
কোনো লক্ষণ নেই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না। এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। এ ধরনের রোগীরাই হঠাৎ হূদেরাগে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে। এ ছাড়া বাড়িতে নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন।
মনে রাখবেন
*৪০ বছর বয়স পার হলেই প্রত্যেকেরই বছরে একবার রক্তচাপ পরীক্ষা করা উচিত।
*হঠাৎ করে ওষুধ বন্ধ রাখা বা অনিয়মিতভাবে ওষুধ গ্রহণ না করা।
*ওষুধ গ্রহণ অবস্থায়ও অন্তত প্রতি মাসে একবার রক্তচাপ পরীক্ষা করা।
* ফাস্টফুড ও ফ্রোজেন ফুড খাওয়ায় সতর্ক থাকা।
*যেহেতু এ রোগে দীর্ঘদিন ওষুধ খেতে হয়, কাজেই বছরে অন্তত একবার কিডনি ও হূৎপিণ্ড পরীক্ষা করানো উচিত।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন