মায়াজম – Miasm
রোগ-জীবাণু( Bacteria, virus, fungus etc. ) আবিস্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক মহা বিপ্লব এনে দেয়। আবিস্কার হল জীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক। মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই এন্টিবায়োটিক এর দিকে ঝুকে পড়লো।
হোমিওপ্যাথগণ জীবাণু নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। তাঁদের দাবী আমরা জীবাণুর ওস্তাদকে ঠিক করি। আর এ ওস্তাদ হলো মায়াজম।
হোমিওপ্যাথির বিধান মতে, মায়াজম হলো রোগের মূল কারণ ( Fundamental Cause ) এবং জীবাণুগুলো হলো উত্তেজক কারণ ( Exciting Cause )।
রোগারোগ্যের ধারা থেকে আমরা অবলোকন করেছি, হোমিওপ্যাথী ওষুধ প্রয়োগের ফলে রোগপ্রতিরোধক শক্তির প্রভাবে কিভাবে জীবাণু বিনাশ করে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে জীবাণুর ওস্তাদ এ মায়াজম আবার কি জিনিস!
মায়াজম অর্থ ক্ষতিকর বিষবাষ্প বা রোগজ কারণ। এটি অতিন্দ্রীয় রোগজ কারণ যা গতিময় ( Dynamis ) যাকে বলা যায় রোগজ শক্তি বা ডিজিজ ডিনামিস। এটা একমাত্র সদৃশ্য বিধানে, প্রকৃত আরোগ্য প্রদানকারী চিকিৎসকের অন্তর্দৃষ্টিতে ( Introspection ) অনুধাবন ( Perceptible )। ইহা প্রচলিত ভারসাম্যহীন কারণ সমূহের উপর একটি মরনাঘাত ( Deathblow )।
সুতরাং মায়াজম হচ্ছেঃ এক ধরনের গতিময় দূষণ মাধ্যম যাহা জীব দেহের মধ্যে বিভিন্ন অংগে একবার প্রবিষ্ট হলে জীবনীশক্তির উপর প্রভুত্ব করে, ব্যক্তিকে সার্বিকভাবে এমনিধারায় দূষিত করে যার পিছনে একটি স্থায়ী রোগজ অবস্থা ( Stigma of dyscrasia ) স্থাপন করে যাহা সম্পূর্ণরুপে মায়াজম বিরোধী প্রতিকারক দ্বারা দূরীভুত না হলে রোগীর সারাজীবন ব্যাপী বিরাজ করবে এবং বংশপরম্পরায় প্রবাহমান থাকে।
( Miasm is a transcendental dynamically polluting media which once gained establishment into the system of living being, overpowers the vital dynamis, pollutes the individual as a whole in such a way that it leaves behind a permanent stigma or dyscrasia which if not completely eradicate with the suitable anti-miasmatic remedy, will persist throughout the life of the patient transmit through Generation to generation ).
মায়াজমই হচ্ছে রোগজ শক্তির ( Disease dynamis ) গতিময় প্রভাব দ্বারা ( Dynamics influence ) সমস্ত রোগ বা অসুস্থতার সৃষ্টি হয়। এর সাথে কোন রোগ ও সিন্ড্রোম এর প্রিসিপিটেটিং ও প্রিডিসপোজিং ( Precipitating and Predisposing ) ফ্যাক্টর এজেন্ট হিসেবে কাজ করে।
মায়াজমকে হ্যানিম্যান ৩ ভাগে ভাগ করেছেনঃ
(১) সোরা ( Psora )
(২) সিফিলিস ( Syphilis )
(৩) সাইকোসিস ( Sycosis )
সোরা ( Psora ):
সোরা হচ্ছে অতিন্দ্রীয়, গতিময় দূষিত রোগজ মাধ্যম ( Morbid transcendental dynamical polluting media ) যাহা জীবদেহে অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে উহাকে পরিবেশ থেকে রোগের আধার ( dyscrasic ) হিসেবে গড়ে তুলে। ইহা কোন বস্তু বা এজেন্ট নহে, একটি সত্তা, একটি অবস্থা ( diathesis ) বা ধাতুগত পূর্বাবস্থা ( Constitutional predisposing ) যাহা জীবের কতকগুলি বৈশিষ্টের উপর নির্ভরশীল।
ইহা হচ্ছে সমস্ত রোগের ভিত্তি, দেহে রোগ জন্মের বন্ধনসূত্র ( bond of acceptance to receive disease ), রোগ গ্রহন করার প্রবেশ দ্বার, এর ব্যতিরেকে কোন রোগ জীবনীশক্তিকে আক্রমন করতে পারে না। জীবনীশক্তির মধ্যে অন্যান্য মায়াজমের আক্রমন এবং আক্রমনের প্রবনতার জন্য সোরাই দ্বায়ী।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, সোরার রোগী কে? সোরার লক্ষণ প্রকৃতি অনেক, তবে কিছু লক্ষণ তুলে না ধরলে লেখার গুরুত্ব থাকে না। রোগীর মানসিক সার্বদৈহিক, আঙ্গিক সর্বস্তরে সোরার লক্ষণ বিদ্যমান। যথা-
(১) রোগী সবসময় কর্মব্যস্ত, দ্রুত।
(২) সবকিছুই অপরিস্কার, অপরিচ্ছন্ন।
(৩) হতাশা, নৈরাশ্য, রোগ সম্পর্কে আশাহীন।
(৪) ঘাম নিঃসরনের জন্য রোগী ভালো থাকে।
(৫) নতুন কিছু করা, নতুন আবিস্কার।
(৬) ভীত, অন্ধকারে ভয় পায়।
(৭) মাথায় শুস্ক খুসকী।
(৮) বেশী বেশী ক্ষুধাপায়, বেশী বেশী খায়।
(৯) রোগী প্রশ্রাব পায়খানা করার স্বপ্ন দেখে, গান গাওয়ার স্বপ্ন দেখা।
সিফিলিস ( Syphilis ):
সিফিলিস মায়াজম হচ্ছে একটি অতিন্দ্রীয় গতিময় দূষিত যৌন রোগজ মাধ্যম। যৌন সংক্রামিত রোগ সিফিলিস টার্শিয়ারী ষ্টেজে অর্জিত বা বংশগত জীবকোষের ক্রোমোজোমাল নিউক্লিও প্রোটিন অবস্থানে আঘাত ঘটিয়ে অতিন্দ্রীয় রোগজ অবস্থার সৃষ্টি করে। ভাইটাল ডিনামিস জীবের মানসিক, শারীরিক এবং আঙ্গিক অর্থাৎ সার্বিক লক্ষণের মাধ্যমে এর পরিচয় প্রকাশ করে। ইহার সকল লক্ষণই ধ্বংসাত্বক।
সিফিলিস মায়াজম কতকগুলি বৈশিষ্ট্য নিয়ে জীবদেহে বিরাজ করে। যথা-
(১) মস্তিষ্ক অলস।
(২) ধ্বংশ, অঘটন, খুন করেই বসে।
(৩) ঘামে বৃদ্ধি।
(৪) পালাইয়া বেড়ায়, আত্মহত্যা করে।
(৫) ভুলে যায় কি বলতেছিল ।
(৬) রাত্রে সকল রোগের বৃদ্ধি।
(৭) চুলে জটা।
(৮) সর্বদিকের বা স্থানের চুল পড়তে থাকে।
(৯) আর্দ্র ও পুরু খুসকি।
(১০) মাংসের প্রতি অনিহা।
(১১) শীত, গরম উভয়ই অসহ্য।
(১২) খর্বতা, লিভারের রোগ, প্যারালাইসিস ( Paralysis ), ক্যান্সার ( Cancer ), ইপিলেপসি ( Epilepsy ), অস্থিক্ষয় ( Decay of bone ), কার্বাঙ্কল ( carbuncle ), শ্বেতী, বধিরতা, তোতলামী ইত্যাদি।
(১৩) মার্ডার, আগুন এরুপ ভয়াবহ স্বপ্ন দেখে।
সাইকোসিস ( Sycosis ):
সাইকোসিস হচ্ছে একটি অতিন্দ্রীয় গতিময় দূষিত যৌন রোগজ মাধ্যম। যৌন সংক্রামিত গনোরিয়া চাপা পড়ে অথবা কুচিকিৎসার ফলে বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে ক্রোমোজোমাল লেভেল আক্রমন করে যাহা অর্জিত জীবে( acquired individual ) বা বংশ ধারায় অভ্যন্তরীন রোগের আধার ( Dyscrasiya ) সৃষ্টি করে।
সাইকোসিস সিউডোসোরিক জীবে আক্রমন করে ভয়ানক, ভীতিজনক, ধ্বংসাত্মক, গভীরতম এবং বর্ননাতীত ক্ষতিসাধন করে।
সাইকোসিস রোগীর লক্ষণরাজী নিম্নরুপঃ
(১) ভীষন এবং ভয়ংকর রাগী, বদমায়েশ, প্রবঞ্চক, সংসারে একজন থাকলেই সাব্বাশ।
(২) সন্দেহ প্রবন, সাধারণত একপার্শ্বে আক্রান্ত হয়।
(৩) অপরের অমঙ্গল চিন্তা, পাগলামী।
(৪) আকাম সাধনে পটু।
(৫) সবচেয়ে নিষ্ঠুর, ধূর্ত।
(৬) মিথ্যাবাদী, স্বার্থপর।
(৭) পশুত্ব স্বভাব।
(৮) আত্মভোলা, শব্দ বা পূর্বের লাইন ভুলে যায়।
(৯) যুক্তি ক্ষমতাহীন।
(১০) আচিঁল থাকা অবস্থায় মানসিক লক্ষণ ভালো থাকে।
(১১) চক্রাকারে বা গোলাকার হয়ে চুল পড়ে যায় এবং অকালে চুল পাকে।
(১২) হিস্টেরিয়া ( Hysteria ), সায়াটিকা ( Sciatica ), হাইড্রোসিল, এজমা ( Asthma ), স্ট্রিকচার, পাথরী পীড়া ( Stone ), উচ্চ রক্তচাপ ( Hypertension ), বাত ( Gout ), পক্স ( Pox ), ফাইলেরিয়া, সন্ন্যাস, টিউমার, টাইফয়েড, চোখের ছানি, ক্রনিক ডিসেন্ট্রি ( Chronic Dysentery ), ভ্যাজাইনিসমাস ইত্যাদি রোগ।
(১৩) রোগী উড়ে যাবার স্বপ্ন দেখে।
একই দেহে একাধিক মায়াজম অবস্থান করে মিশ্র মায়াজম ( Mixed miasm ) রুপে রোগী দেহে প্রভূত্ব করতে থাকে। এ অবস্থায় যে মায়াজমের লক্ষণ প্রধানরুপে থাকে, তার চিকিৎসাই প্রথমে শুরু করতে হয়।
মোটের উপর জীবাণুই রোগের মূল কথা নয়। একই পরিবেশে নির্দিষ্ট জীবাণু সকলকে সমানভাবে আক্রমন করতে পারে না। ফান্ডামেন্টাল কারণ মায়াজম। মায়াজমে প্রিডিসপোজিং অবস্থার উপর ভিত্তি করে এক্সাইটিং ফ্যাক্টর হিসেবে জীবাণু দেহের ক্ষতিসাধন করে। উপযুক্ত এন্টিমায়াজমেটিক(ওষুধ) প্রতিকারক (Remedy) প্রয়োগ হলে দেহের প্রতিরোধক ক্ষমতা বলে ওষুধের ফারমাকো-ডিনামিক্যাল একশন( Pharma-co-dynamical action ) দ্বারা জীবাণু নাশ হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন