জীবন যুদ্ধে জয়ী নারীদের গল্প
বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য নারী রয়েছে যারা নিজেদের মনোবল ও ইচ্ছাশক্তির কারণে হয়ে উঠেছে স্বাবলম্বী। অনেকে আছেন যারা জীবন যুদ্ধে পরাজিত না হয়ে সেই যুদ্ধকে জয় করার জন্য নিজ হাতেই ঘুরাচ্ছেন জীবনের চাকা। এমন অনেকে আছেন যারা আর দশজনের মতো সুস্থ্য স্বাভাবিক না হলেও অনেকক্ষেত্রে সুস্থ্য স্বাভাবিকদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। সেরকম কিছু নারীদের তথ্য আমরা এই পেজটিতে তুলে ধরেছি।
বিথী
যশোর শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ইজিবাইক নিয়ে ছুটে চলেছেন বিথী। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানকে নিয়ে কূলহারা বিথী পড়ে যান মহা সংকটে। জীবনের এই সংকটময় মূহুর্তেও সে কারও কাছে হাত পাতেননি। নিজের প্রচেষ্টায় ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্ত থেকে সমাজের শত বাঁধা বিপত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইজি বাইকের স্টিয়ারিং ধরেন বিথী। ইজিবাইক চালিয়ে বিথী তার নিজের ও দুই সন্তানের খাওয়া-দাওয়া ও পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন। পুরুষ শাসিত সমাজে বিথী দেখিয়ে দিলেন কিভাবে জীবনের চাকা সচল রাখতে হয়। এসব ক্ষেত্রে সমাজ বাঁকা চোখে তাকাবেই। তাই বলে সমাজের ভয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত না পেতে নিজের প্রচেষ্টাতে কিছু একটা করা অনেক ভালো।
খালেদা
বিথীর মতো আরও এক সংগ্রামী নারী হচ্ছেন খালেদা। জীবনের চলতি পথে থেমে না থেকে তিনি ধরেছেন রিক্সার হ্যান্ডেল। ভন্ড-প্রতারক স্বামীর কাছে প্রতারিত হয়ে খালেদা এই যুদ্ধে নেমেছেন। খালেদার যখন সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় তখন তার স্বামী অন্য নারীর হাত ধরে তাকে ছেড়ে চলে যায়। এখন মানসিক বিকারগ্রস্ত মা, সন্তান ও তাকে নিয়ে তিন জনের সংসার। এই তিনজনের দু বেলা দু মুঠো খাবার জোগাড় করার জন্যই তার এই সংগ্রাম। জামালপুর জেলা সদরের টিক্কাপট্টিতে তাদের বসবাস। খালেদা চাইলে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে পারতো। কিন্তু পুরুষ নামক ভন্ড-প্রতারকদের প্রতি একবুক ঘৃণা নিয়ে খালেদা নিজেই জীবনের হাল ধরেন। সমাজের কে কি বললো সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
খাদিজা
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার গোরাশাল গ্রামে নদীর পাড়ে ছোট্ট এক কুঁড়েঘরে খাদিজার পরিবারের বসবাস। পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পঞ্চম শ্রেণীর পর খাদিজার আর লেখাপড়া হয়নি। এরপর তাকে পারিবারিক কাজে হাত লাগাতে হয়। কিন্তু এর কিছুদিন পরই খাদিজা ব্র্যাক-এর ‘স্টার’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। সুযোগ হাতছাড়া না করে মোটর সাইকেল ঠিক করার কাজে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন তিনি।প্রথমদিকে অনেক কটাক্ষের শিকার হতে হয় খাদিজাকে। অনেকেই প্রশ্ন তোলে, ‘একটা মেয়ে কী করে বাজার এলাকায় কাজ করবে? সে কী পারবে কোনো সাফল্য আনতে?’ যখন আশেপাশের সকল মানুষ তাকে রুখে দিতে সরব, খাদিজা তখন কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে এক মনে এগিয়ে চলেছে তার লক্ষ্যের পথে। এই পথে এগিয়ে যেতে বাবাই সবচেয়ে বেশি সাহায্য এবং প্রেরণা জুগিয়েছেন, জানালেন খাদিজা। তার পরবিার এখন স্বপ্ন দেখে, কোনো একদিন নিজ কাজের মাধ্যমে খাদিজা একজন স্বাধীন-স্বনির্ভর নারীতে পরিণত হবে। এমনকি ব্র্যাক-এর রাজশাহী জোনের অফিসে কর্মরত সবারই খাদিজার প্রতি রয়েছে উঁচু প্রত্যাশা। এবং তারা সবাই চান, মানুষ খাদিজাকে একটি উদাহরণ হিসেবে নিয়ে শিখুক, লিঙ্গ বৈষম্য না থাকলে নারী-পুরুষ একই ক্ষেত্রে সমান অবদান রাখতে পারে।
সুমী আক্তার
মানুষের ইচ্ছা থাকলে পৃথিবীতে অসম্ভব এমন কাজ খুব কমই রয়েছে। বিশ্বাস না হলে নাটোরের বাগাতিপাড়ার কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী সুমী আক্তারকে দেখতে পারেন। সুমীদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তার বাবা একজন দিনমজুর। সুমীর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন কিছু রোজগারের জন্য বিল থেকে শামুক কুড়াতে গিয়ে চোরদের কেটে রেখে যাওয়া বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পড়ে সে। ওই সময় চিকিৎসকরা তার দুই হাতের কব্জী কেটে ফেলেন। তখন থেকে হাত কাটা মেয়ের বিয়ে কি করে হবে মা বাবার এমন দুঃশ্চিন্তা আর গরীব মা বাবা কয়দিনই বা তাকে খাওয়াবে এমন ভাবনা থেকেই সে প্রতিজ্ঞা করে লেখাপড়া করেই নিজের পায়ে দাঁড়াবে। এমন ইচ্ছা থেকেই কব্জী হারানো সুমি শুরু করে মুখ দিয়ে কলম ধরে লেখা। বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় থেকে সে মুখ দিয়েই লিখতো। প্রাথমিক সমাপনি পরীক্ষাও দিয়েছে মুখ দিয়েই। তবে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে দুই বাহু দিয়ে লেখা শুরু করে সুমি। এখন পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায় অকৃতকার্য সুমী। সমস্যা একটাই, তা হলো আর্থিক সংকট। সুমীর দৃঢ় সংকল্প আর্থিক সংকট ছাড়া শারীরিক কোনো সমস্যাই তাকে লেখাপড়া করে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরিতে বাঁধা তৈরি করতে পারবে না। সুমীর জন্য শুভকামনা রইলো।
হাওয়া আক্তার জুই:
জুইয়ের কথা সকলের মনে আছে নিশ্চয়ই। ২০০৮ সালে তাকে নিয়ে মিডিয়ায় অনেক প্রচার প্রচারণা হয়েছিল। নিরপরাধ জুই শুধুমাত্র স্বামীর নিষেধ অমান্য করে পড়াশোনা করায় পাষন্ড স্বামী জুইয়ের ডান হাতের সবগুলো আঙুলই কেনে ফেলে। যাতে জুই হাত দিয়ে লিখতে না পারে। জুইয়ের স্বামী রফিক জুইয়ের পাঁচটি আঙুল কেটে নিলেও জুইয়ের মধ্যে যে মনোবল ছিল তা কিন্তু কেড়ে নিতে পারে নি। তাইতো সেই জুই পরিস্থিতি সামলে নিয়ে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে মানবিক শাখায় এইচ.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং ‘এ’ গ্রেড (জিপিএ-৪.৩০) পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সে এখন নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন।
সূর্যমনি হেমরম
শারীরিক প্রতিবন্ধী এই মেয়েটির একটি হাত নেই। যে হাতটি রয়েছে সেটিও স্বাভাবিক নয়। এই হাতে তার তিনটি মাত্র আঙুল রয়েছে। এই তিন আঙুল দিয়েই সে যা করছেন তা যাদের সুস্থ্য স্বাভাবিক হাত ও ১০টি আঙুল রয়েছে তাদের জন্য শিক্ষনীয়। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্তিক গোষ্ঠী (আদিবাসী) সাঁওতাল সম্প্রদায়ে তার জন্ম। ভিটেমাটিও নেই তাদের। বাবা রাপি হেমরম ক্ষেতে কাজ করে সংসার টিকিয়ে রেখেছে কোনো রকমে। মেয়ের লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে স্বামীর সঙ্গে সখিনা সরেনও ঘরের বাইরে বেড়িয়ে পড়েন। অভাব অনটন থাকলেও বোঝার উপায় নেই। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ফল ভাল করেছিল সূর্যমনি। পঞ্চম শ্রেণিতেও ভাল ফলাফল করে এলাকায় বিস্ময়কর বালিকা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এস.এস.সি পরীক্ষায়ও সে ভালো ফলাফল করেন।
আছমা আক্তার
সুমী আক্তারের মতো একটি দুর্ঘটনায় আছমা আক্তারেরও দুই হাতের কব্জি দেহ থেকে বাদ পড়ে যায়। বোমার আঘাতে আছমা আক্তারের দুই হাতের কব্জি উড়ে যায়। দু’হাতের দু’টি কব্জি বোমার আঘাতে উড়ে গেলেও অদম্য ইচ্ছা ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে স্বপ্ন জয়ের লক্ষ্যে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে আছমা আক্তার (১৫)। ফেনী সোনাগাজী উপজেলার ওলামা বাজার হাজী সেকান্তর মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আছমা আক্তার ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। অদম্য আছমা আক্তার ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর পশ্চিম চরচান্দিয়া গ্রামের এক দিনমজুর পরিবারে জন্ম। জন্মের এক বছর পর পিতা এজাহারুল হক মারা যান।
১৯৯৯ সালের মার্চ মাস। আছমার বয়স মাত্র ৩ বছর। বসত ঘরের পিছনে সাথী দের নিয়ে খেলা করতে গেলে লাল টেপ মোড়ানো বল আকারের একটি বস্তু দেখতে পেয়ে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তের তার হাতের দুটি কব্জি বিস্ফোরণে উড়ে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষত-বিক্ষত হয়ে অজ্ঞান অবস্থায় মাটিতে লুটে পড়ে আছমা। পাড়া-পড়শির বাড়িতে ঝি’র কাজ করে মা ছালেহা বেগম ভিটে মাটি বিক্রে করে চিকিৎসা করে আছমা আক্তারকে সুস্থ করে তুললেও কিন্তু হারাতে হয়েছিল তার দুটি হাতের কব্জি। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে পাড়া-পড়শিদের বাড়িতে কাজ করে অধম্য সাহস ও মনোবল রেখে ছালেহা খাতুন ৬ বছরের প্রতিবন্ধী মেয়েকে আগলে রেখে অতি দুঃখ কষ্টে আছমাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। উদ্যমী এই বোনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।
সুমাইয়া ফারহানা
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সুমাইয়া ফারহানা’র অদম্য মেধাকে দমাতে পারেনি। সকল প্রতিকূলতা জয় করে সে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। বিকলাঙ্গ এই মেয়েটির দুই পা স্বাভাবিক নয়। একটি পা নেই বললেই চলে তা অতন্ত ছোট। অন্য পায়েও সমস্যা। জন্ম থেকেই তার এ অবস্থা। ছোট বেলা থেকেই লেখাপাড়ার প্রতি তার অদম্য আগ্রহ। সে জামালপুর সদর উপজেলার কোটামনী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় সে ভাল ফল করেছিল।
সে জামালপুর শহরের ফুলবাড়ীয়া দড়িপাড়া এলাকার সৌদি প্রবাসী সামোছ উদ্দিনের মেয়ে। মাতা সুফিয়া বেগম একজন গৃহিনী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, পড়ালেখার প্রতি সে খুবই মনোযোগী। কিন্তু বিভিন্ন সময় অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে। তার পেছনে চিকিৎসা ও ওষুধ বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়। প্রতিমাসে প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে সে যা পায় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। সুমাইয়া ফারহানা বলেন, আমি কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাইনা। সুমাইয়া ফারহানার মতো যদি অন্য সবার এ ধরনের মনোভাব থাকতো তাহলে আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর হয়ে গড়ে উঠতো। বোন আপনার প্রতি অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।
আমাদের চারপাশে এরকম আরও শত শত উদাহরণ রয়েছে। যারা সমাজের করুণার পাত্র হয়ে না থেকে নিজ চেষ্টায় ঘুরে দাড়াচ্ছেন। আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সব গুণ থাকা সত্ত্বেও সামান্য ঝড়েই ভেঙ্গে পড়ি। তারা এই মানুষগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাড়াতে পারবেন বলে আশা করি।
Leave a comment
You must be logged in to post a comment.