বাইসাইকেল যখন মুক্তিযোদ্ধার হজ বাহন !
জাফর ফরাজী (৬৪) একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর এটাই হলো তার স্বপ্ন পূরণে বাধা হওয়ার একমাত্র কারণ। ৫৩৫ দিন ধরে তিনি ঘুরছেন বাইসাইকেলে করে।
মঙ্গলবার বিকেলে বাইসাইকেলে চড়ে সিলেট থেকে ময়মনসিংহ আসেন এ মুক্তিযোদ্ধা। এরপর রাত প্রায় সাড়ে ১১টার সময় শহরের আমপট্টি এলাকার একটি মোড়ে হঠাৎ দেখা হয় তার সঙ্গে।
কিছুক্ষণ কথা বলার পর মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার এ বাসিন্দা জানান, বাইসাইকেলে করেই সৌদি আরবে হজ করতে যাবেন তিনি।
এরপর ধীরে ধীরে জানান তার বাইসাইকেল সফরের কথা। জাফর ফরাজী পাকিস্তান হয়ে হজ করতে যেতে চেয়েছিলেন সৌদি আরবে। কিন্তু, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় পাকিস্তান তাকে ভিসা দেয়নি।
কথা বলতে বলতে খানিকটা প্রতিবাদের সুরেই জাফর ফরাজী বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে যেহেতু পাকিস্তান আমাকে ভিসা দেয়নি, তাই ঘুরপথে ভারত-চীন-আফগানিস্তান-ইরান-ইরাক হয়ে সৌদি আরব যাবো।
একাত্তরের রণাঙ্গণের বীর সৈনিক জাফর ফরাজী। কুমিল্লার ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মোহাম্মদ সেলিমের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি।
১৯৭১ সালে দেশ পাকিস্তানি শোষণ মুক্ত হওয়ার পর তিনি দর্জি পেশা বেছে নেন।
জাফর ফরাজীর শখ ছিল, বাইসাইকেলে বিশ্বভ্রমণের পাশাপাশি সৌদি আরবে হজ পালন করা। আর তার সেই স্বপ্ন পূরণে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
তিনি অভিযোগ করেন, পাকিস্তান হয়ে সৌদি আরবে যেতে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দু’দফা ডিও লেটার পাকিস্তান দূতাবাসে জমা দিলেও ভিসা দেয়নি। কারণ, ওই ডিওলেটারে লেখা- ‘তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা’।
পাকিদের হীনমন্যতার এ বিষয়টি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতেই এ অভিনব সাইকেল ক্যাম্পেইনে নেমেছেন মুক্তিযোদ্ধা জাফর ফরাজী।
এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বাইসাইকেল চড়ে যখন বাড়ি থেকে বের হই, তখনই ইচ্ছা ছিল পাকিস্তান হয়ে প্রথমে ইরাকে যাবো বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানীর (রহ.) মাজার জিয়ারত করতে। এরপর সৌদি আরবে যাবো হজ করতে। পাকিস্তান হয়ে সেখানে যেতে পারলে আমার জন্য সহজ হতো।
কিন্তু দু’দফা আবেদন করার পরেও পাকিস্তান ভিসা না দেওয়ার প্রতিবাদে বাইসাইকেলে করেই গত ৫৩৫ দিনে তিনি দেশের ৬৪ জেলা চারবার ঘুরেছেন। একবার গিয়েছেন ভারতের আজমীর শরীফে।
জাফর ফরাজী জানান, পাকিস্তানের ভিসা না পেলেও বাইসাইকেলে করেই ভারত-চীন-আফগানিস্তান-ইরান-ইরাক হয়ে সৌদি আরবে হজ পালনের লক্ষ্য রয়েছে তার।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ভারত ও ইরানের ভিসা পেয়েছি। বাদ বাকি দেশগুলোর ভিসাও সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
সাইকেলের সামনের অংশে ঝুলিয়ে রেখেছেন একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা- ‘বাইসাইকেলযোগে বিশ্বভ্রমণ।’ তার ওপরে শোভা পাচ্ছে, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মিনি সাইজ পতাকা।
সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে একটি সাদা বস্তা। তাতে রয়েছে, কাফনের কাপড়সহ অন্যান্য পোশাক।
ঘুরতে ঘুরতে দিন ফুরালে রেলস্টেশন কিংবা ফুটপাতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েন এ মুক্তিযোদ্ধা জাফর ফরাজী।
কথা শেষ হতেই বাইসাইকেল সঙ্গী করে এক গাল হাসি দিয়ে ছুট দেন ময়মনসিংহ শহরের রেলওয়ে জংশনের উদ্দেশে।
এ যেন জাফর ফরাজীর আরেকটি যুদ্ধ! তার এ নির্মল হাসির অর্থ দাঁড়ায়, যুদ্ধ করে দেশকে জয় করেছি; আর এ যুদ্ধ তো কিছুই নয় !
Leave a comment
You must be logged in to post a comment.