পনেরোটি লক্ষণে বুঝবেন দেহে আয়রনের অভাব
দেহে যে সকল পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয় তার মধ্যে আয়রন অন্যতম। শরীরে আয়রনের ঘাটতিতে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই উপাদানটি দেহে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের অন্যতম উপাদান। গোটা দেহে অক্সিজেন সরবরাহের কাজটি করে হিমোগ্লোবিন। দেহে আয়রনের অভাব ঘটলে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পাবে।
১. অবসন্নবোধ
জার্নাল অব আমেরিকান সোসাইটি অব হেমাটোলজির ডেপুটি এডিটর ন্যান্সি বারলিনার বলেন, প্রতিদিন নানা কাজের চাপে ক্লান্তিভাব আসতে পারে। তবে তা আয়রনের অভাবের কারণে কিনা তা বোঝা কঠিন। এ সময় নারীদের প্রচণ্ড অবসন্ন হয়ে পড়েন। তবে নারী-পুরুষ উভয়েরই আয়রনের ঘাটতি হলে দুর্বলতা, কাজে ধ্যান দেওয়া এবং বিরক্তিবোধ ইত্যাদি ব্যাপক আকারে দেখা দিবে। আয়রনের অভাবে দেহের টিস্যুতে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারেন না। ফলে এমন বোধ হয়।
২. অতিমাত্রায় ঋতুস্রাব
নারীদের মধ্যে আয়রন ঘাটতিতে অতিমত্রায় ঋতুস্রাব দেখা দেয়। এ তথ্য জানিয়েছেন নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাই সেন্ট লুকস রুজভেল্টের গাইনিকোলজির পরিচালক জ্যাকুয়েস মরিৎজ। তিনি জানান, স্বাভাবিক নিয়মিত ঋতুস্রাবে দুই থেকে তিনি টেবিল চামচের সমপরিমাণ রক্ত বের হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিমাণ রক্তক্ষরণ ঘটে।
৩. বিবর্ণ চেহারা
মাঝে-মধ্যে বিবর্ণ চেহারা এবং অসুস্থ অবস্থাকে অদল-বদল করা যায়। ত্বকের লাল ভাবটি দেয় যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত। আর আয়রনের অভাবে হিমোগ্লোবিনের অভাব ঘটে। ফলে রক্তের লালচে ভাবটি চলে যায়। তখন চেহারা ফ্যাকাশে বা পাংশু বর্ণ দেখায়। ছোট টর্চের আলোতে ঠোঁট বা কান বা দাঁতের মাড়িতে রক্তশূন্যতা চোখে পড়বে বা তা আগের মতো দেখাবে না।
৪. নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হবে
যতো গভীরভাবেই শ্বাস নেন না কেনো, অক্সিজেনের অভাব ঘটলে নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হবেই। এ ছাড়া সিঁড়ি ভেঙে উঠতে বা একটু হাঁটাহাঁটি করলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হবে।
৫. হৃদযন্ত্রটি ধড়ফড় করবে
অতিরিক্ত পরিশ্রমে হৃদযন্ত্র ধড়ফড় করে, স্পন্দন মিস হয়, হৃদস্পন্দনে শব্দ হয় বেশি ইত্যাদি। এতে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। টেক্সাস হার্ট ইনস্টিটিউট জার্নাল জানায়, এ ধরনের সমস্যা হয়ে দেহে আয়রনের অভাব হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত।
৬. পায়ে ভারসাম্যহীনতা
আয়রনের অভাবে পা দুটো কাঁপাকাঁপি করে। হাঁটা-চলাতে ভারসাম্য থাকে না। এ তথ্য জানায় জন হপকিন্স মেডিসিন। আয়রনের পরিমাণ যতো কমবে এই সমস্যা ততো বেশি বাজে আকার ধারণ করবে।
৭. মাথাব্যাথা
আয়রনের অভাবে মস্তিষ্কেও অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। ন্যাশনাল হেডেক ফাউন্ডেশন জানায়, অক্সিজেনের অভাবে টিস্যুগুলোতে সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং রক্তবাহী শিরাগলো স্ফীত হয়ে যায়। এর কারণে মাথাব্যাথা শুরু হয়।
৮. বরফ এবং অখ্যাদ্যের প্রতি আগ্রহ
অদ্ভুত একটি সমস্যা তৈরি হয় খাবারের ক্ষেত্রে। অতিমাত্রায় আয়রনের অভাবে নারীদের মধ্যে বরফ খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ ছাড়া খাদ্যের অভাবে কাদা বা চক জাতীয় জিনিস খাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
৯. অকারণে দুশ্চিন্তা
আপনার জীবনে বিষণ্নতা বা ঝামেলা কম থাকলেও অকারণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিবে আয়রনের কমতি হলে। অক্সিজেনের অভাবে স্নায়বিক দুর্বলতা দেখা দেয়। তা ছাড়া হৃদযন্ত্রের স্পন্দন বেড়ে যাওয়ার কারণে আপনার ওড়ার মতো অনুভূতি হবে। ফলে হঠাৎ করে আপনার মধ্যে ভীতি বা দুশ্চিন্তা দেখা দিবে।
১০. চুল পড়া
আয়রনের অভাব খুব বেশি হলে এবং এ কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দিলে চুল পড়া শুরু হয়। এ সময় দেহের সব অক্সিজেন গুরুত্বপূর্ণ অংশের কাজে চলে যায়। এতে চুল পড়া শুরু হয়। দেখা গেছে, এমন সমস্যায় প্রতিদিন ১০০টি করে চুল পড়ে যায়।
১১. নিরামিষভোজী হলে
সব ধরনের আয়রন এক উৎস থেকে আসে না। মাংস, ডিম এবং মাছ থেকে যে আয়রন পাওয়া যায় তা উদ্ভিজ্জ আয়রনের চেয়ে দুই থেকে তিন গুন বেশি কার্যকর বলে জানান ‘দ্য ওয়ান ওয়ান ওয়ান ডায়েট’ বইয়ের লেখক পুষ্টিবিজ্ঞানী রাইনা বাতানে। ঘন রঙের পাতাবহুল সবুজ এবং কালাই জাতীয় খাদ্যে আয়রন থাকে। এদের সঙ্গে ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ জাম বা আঙুরের মতো ফলের সমাহার ঘটালে সঠিক উপায়ে আয়রন গ্রহণ করা যাবে।
১২. থায়েরয়েডে কার্যক্ষমতা হ্রাস
আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব হাইপোথিরোডিজম জানায়, আয়রনের অভাব আপনার থায়েরয়েড গ্রন্থির কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে দেহে নানা বিপাকীয় জটিলতা দেখা দেয়।
১৩. যখন গর্ভবতী থাকবেন
গভাবস্থাকালীন যে শিশুটি ভূমিষ্ট হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে তারও আয়রন প্রয়োজন হয়। ফলে মায়ের দেহ থেকে শিশু তা গ্রহণ করে। ফলে মায়ের দেহে আয়রনের অভাব দেখা দেয়। আয়রনের অভাবেই গর্ভবতী নারীরা বমি করেন।
১৪. জিহ্বার অদ্ভুত রঙ
আপনার জিহ্বার সাধারণ রঙটি অদ্ভুত হয়ে যায়। আয়রনের অভাবে মায়োগ্লোবিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। লাল রক্তকণিকার এক ধরনের প্রোটিন জিহ্বার পেশি গঠনে সহায়তা করে। আর রক্তের ওই কণিকা গঠনের প্রয়োজনীয় উপাদান আয়রন। তাই আয়রনের অভাবে জিহ্বার ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ কমে যায় এবং এর রঙ নষ্ট হয়ে যায়।
১৫. সেলিয়াক বা ইনফ্লেমাটরি বাউয়েল রোগ
ক্রনস এবং আলসেরাটিভ কলিটিসের মতো সেলিয়াক বা ইনফ্লেমাটরি বাউয়েল জাতীয় রোগ দেহের পুষ্টি উপাদান শুষে নেওয়ার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রদাহ এবং হজমে সহায়ক এনজাইমের স্বল্পতা দেখা দেয়। এসব হয় আয়রনের অভাবে।
প্রতিদিন কী পরিমাণ আয়রন প্রয়োজন :
আয়রনের প্রয়োজনের মাত্র সবার জন্য এক নয়। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে, ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়েসী নারীদের ক্ষেত্রে প্রতিদিন ১৮ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন। আর গর্ভাবস্থায় এই পরিমাণ ২৭ মিলিগ্রামে দাঁড়ায়। যে মায়েরা বুকের দুধ খাওয়ার তাদের প্রয়োজন প্রতিদিন ৯ মিলিগ্রাম। যেসব নারীর ৫০ বছর বয়েসের পর ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে তাদের প্রতিদিন মাত্র ৮ মিলিগ্রাম আয়রনই যথেষ্ট। তবে আয়রনের অভাবের এমন লক্ষণ প্রকাশ পেলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
আয়রনের অভাবের জন্য হমিওপ্যাথিক কোন ঔষুধ খেতে হবে।