টালি পাম প্রজাতির শেষ গাছটি ফুল দেয়ার অপেক্ষায়
ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফুলার রোডে বৃটিশ কাউন্সিল ভবনের উল্টো দিকে ইউনিভার্সিটির প্রোভিসির বাসভবন। সেখানে রয়েছে নিঃসঙ্গ একটি বৃক্ষ, এ পৃথিবীতে যার কোনো সঙ্গী নেই। মধ্যবয়সী তাল গাছের মতো দেখতে গাছটি। নাম টালি পাম। বৈজ্ঞানিক নাম কোরিফা টালিরিয়া রক্সব।
এ গাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি জীবনে একবারই ফুল-ফল দেয়। এ জন্য ৫০ বছরের কাছাকাছি সময় নেয়। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে টালি গাছটির বয়স ৫০ বছরের কাছাকাছি। সে হিসেবে কিছুদিনের মধ্যে গাছটি ফুলে ভরে উঠবে। আর তখনই বীজ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা যাবে হারিয়ে যেতে বসা এ প্রজাতিটি। গাছটি জীবনে একবারই ফুল দেয় এবং এরপরই মারা যায়।
টিসু কালচারের মাধ্যমেও গাছটি বিলুপ্তির দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে ধারণা করা হতো। বাংলাদেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করে এমন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, এ প্রজাতিটির টিসু কালচার হয় না।
কোরিফা টালিরিয়া ভারত উপমহাদেশের স্থানীয় প্রজাতি। আগে শ্রী লংকা, সাউথ ইনডিয়াতে এ গাছটি দেখা যেতো। ১৯১৯ সালে বিখ্যাত বৃটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ডাবলিউ রক্সবার্গ এ প্রজাতিটি প্রথমবারের মতো বৈজ্ঞানিক উপায়ে তালিকাভুক্ত করেন।
এর আগ পর্যন্ত প্রজাতিটি উদ্ভিদবিজ্ঞানের জগতে অনাবিষ্কৃত ছিল। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই টালি পাম বৃক্ষটিকে শনাক্ত করেন বিশ্বখ্যাত প্রয়াত উদ্ভিদবিদ, ঢাকা ইউনিভার্সিটির উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক প্রফেসর ড. আবদুস সালাম। গত শতাব্দীর ৫০ দশকে তিনি এ গাছটি প্রথম দেখতে পান।
কিন্তু গাছটি কোন প্রজাতির তা তিনি শনাক্ত করতে পারেননি। তবে এটি যে বিরল ও দুর্লভ প্রজাতির গাছ, তা তিনি বুঝতে পারেন এবং কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন গাছটি যেন না কেটে ফেলা হয়। মূলত তার একক প্রচেষ্টার ফলেই গাছটিকে প্রোভিসির বাসভবনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কিছুদিন আগ পর্যন্ত এ প্রজাতিটির আরেকটি গাছ ছিল পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। এ গাছের ফুল দেখতে খেজুরের ছড়ার মতো। সেখানে যখন ফুল ফোটে তখন গ্রামের মানুষ ধারণা করলো এটি ভূতপ্রেতের কাজ।
ড. শ্যামল কুমার বসু নামে বিখ্যাত এক পাম বিশেষজ্ঞ এ খবর শুনে প্রচ- কৌতূহল বোধ করেন এবং গাছটি দেখতে সেই গ্রামে যান।
তিনি অপার বিস্ময়ে লক্ষ করেন, গ্রামবাসী যাকে তাল গাছ বা খেজুর গাছ বলে ধারণা করছে সেটি আসলে একটি টালি পাম গাছ। ড. বসু এ গাছটি শনাক্ত করার আগ পর্যন্ত ধারণা করা হতো, প্রজাতিটি পৃথিবী থেকে চিরবিলীন হয়ে গেছে।
তিনি গ্রামবাসীকে প্রকৃত বিষয় খুলে বলে অনুরোধ জানান, যাতে গাছটিকে রৰা করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই গ্রামবাসী গ্রাম থেকে ‘ভূত তাড়ানোর উদ্দেশ্যে’ গাছটি কেটে ফেলে।
এ ঘটনা ১৯৭৯ সালের। এরপরই বিজ্ঞানীদের বদ্ধমূল ধারণা জন্মে, এ প্রজাতিটি হারিয়ে গেছে বিশ্ব থেকে। ২০০১ সালে সেই শ্যামল বসু বেড়াতে আসেন বাংলাদেশে এবং সৌভাগ্যক্রমে টালি পাম গাছটির সংস্পর্শে আসেন। তিনি জানালেন, এটিই এ প্রজাতিটির পৃথিবীর একমাত্র গাছ। এরপর এ দেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করে জানতে পারেন তার কথা সর্বাংশে সঠিক। বর্তমানে গাছটিকে একটি কংকৃটের দেয়ালের মাধ্যমে ঘিরে রাখা হয়েছে। এটিকে রক্ষা করার জন্য চলছে ব্যাপক প্রচেষ্টা। রাখা হয়েছে একজন মালি, যিনি গাছটি দেখাশোনা করেন।
ইউনিভার্সিটির প্রোভিসি প্রফেসর আ ফ ম ইউসুফ হায়দার বলেন, তিনিও উন্মুখ হয়ে আছেন কখন গাছটি ফুল দেয়।
Leave a comment
You must be logged in to post a comment.