নবজাতকের কোষ্ঠকাঠিন্য
নবজাতকের মল বা পায়খানার ধরন, পরিমান এবং কতবার করা উচিত, এসব প্রশ্ন নিয়ে বাবা মায়েদের চিন্তার শেষ নেই। প্রকৃতপক্ষে নবজাতকের পায়খানার এত বেশী ধরন আছে যে কয়েক বাচ্চার মায়েরাও হয়ত সবগুলো সম্পর্কে জানেন না। তাই আজকের আলোচনায় আমরা চেষ্টা করেছি বাচ্চার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে কিংবা বাচ্চার খাবারের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাচ্চার পায়খানার ধরন কিভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, নবজাতকের পায়খানা কখন স্বাভাবিক, কখন নয় সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার। এ আলোচনা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন কখন আপনার চিন্তিত হওয়া দরকার এবং দ্রুত ব্যাবস্থা নেয়া দরকার।
নবজাতকের পায়খানা দিনে কতবার হবে?
বাচ্চা বুকের দুধ খাক বা ফর্মুলা, জন্মের প্রথম ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিবার খাওয়ার পর পায়খানা করতে পারে। বাচ্চা বুকের দুধ খাচ্ছে নাকি ফর্মুলা, তার উপর নির্ভর করে নবজাতকের পায়খানার ধরন ভিন্ন হতে পারে। বুকের দুধ খাওয়া বাচ্চাদের মল সাধারনত হলুদ এবং পাতলা হয় আর ফর্মুলা খাওয়ানো বাচ্চাদের মল গাঢ় বর্ণের এবং ঘন হয়।
ছয় সপ্তাহ পর যখন বাচ্চার পরিপাকতন্ত্র সুগঠিত হয়ে ওঠে তখন তার মল-ত্যাগের অভ্যাস পরিবর্তিত হয়ে যায়। তবে নবজাতক কত ঘন ঘন পায়খানা করবে তা কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যদিও ৩ থেকে ৬ বার পায়খানা করাকে আদর্শ ধরা হয়, তবে বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চারা ফর্মুলা খাওয়ানো বাচ্চাদের মত ঘন ঘন পায়খানা করেনা।
বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চা যদি বেশ কয়েকদিন পায়খানা না করে তবে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। বুকের দুধ আর ফর্মুলা একই ভাবে হজম হয়না। বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের নিয়মিত প্রস্রাব করা (দিনে ৬ থেকে ৮ বার) কিন্তু কয়েকদিন টানা পায়খানা না করা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চা ৭ দিন পর্যন্তও পায়খানা না করে থাকতে পারে। যদি বাচ্চার পায়খানা না হয় তবে তার হাবভাবের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদি তাকে সন্তুষ্ট মনে হয় এবং তার পেট নরম থাকে তাহলে তেমন কোন সমস্যা নেই। তবে যদি তার পেট শক্ত মনে হয় এবং তাকে অসন্তুষ্ট মনে হয় তবে ধরে নেয়া যায় সে কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত। এক্ষেত্রে তার পায়খানাতে শক্ত এবং শুকনো ভাব থাকবে। পায়খানা না হওয়ার সাথে সাথে বাচ্চাকে অসুস্থ বা অখুশি মনে হলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
ফর্মুলা খাওয়ানো বাচ্চাদের দিনে অন্তত একবার মলত্যাগ করা স্বাভাবিক। এ ধরনের বাচ্চা যদি ২ বা তার বেশীদিন পায়খানা না করে তবে ধরে নেয়া যায় সে কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত। এছাড়াও পায়খানা যদি শক্ত এবং গাছের গুঁড়ি আকৃতির হয় সে ক্ষেত্রেও কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্ভাবনায় বেশী। এ ধরনের হলে শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করতে হবে কারণ কোষ্ঠকাঠিন্য অ্যালার্জির কারনে হতে পারে আবার হয়তোবা বাচ্চাকে যে ফর্মুলা খাওয়ানো হচ্ছে তা তাকে সুট করছেনা বলেও হতে পারে।
নবজাতকের প্রথম পায়খানা
নবজাতকের প্রথম মল গামের মতো আঠালো, আর্দ্র ও কালচে বর্ণের হয়ে থাকে। মিকোনিয়ামের কারণে এ রকম হয়। শতকরা ৯০ জনের বেশি পূর্ণ গর্ভকাল পাওয়া (৩৭ সপ্তাহের বেশি গর্ভকাল পেরোনো) নবজাতক জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ও বাকিদের বেশিরভাগই জন্মের ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রথম পায়খানা করে থাকে। সুতরাং শিশুর প্রথম মলত্যাগের জন্য এ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। এ সময় শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাইয়ে যেতে হবে, অন্য কিছুর দরকার নেই। অন্যদিকে অত্যধিক কম ওজনের নবজাতকের (জন্মকালীন ওজন ১৫০০ গ্রামের কম) ২০ শতাংশ প্রথম ২৪ ঘণ্টায় মলত্যাগ নাও করতে পারে।
জন্মের প্রথম দিকে মিকোনিয়ামের (গর্ভে থাকাকালীন অন্ত্রে উৎপন্ন হওয়া একধরনের পদার্থ) কারনে বাচ্চার মল ঘন ও গাড় সবুজ বর্ণের হয়। বাচ্চা খাওয়া শুরু করার পর মিকোনিয়াম আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে থাকে এবং মলের রঙ হলুদ এর দিকে যেতে থাকে। তবে বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের ডায়েট বা ফর্মুলা খাওয়ানো বাচ্চাদের ফর্মুলার ধরন ও পরিমান এর উপর নির্ভর করে রঙ পরিবর্তিত হতে পারে। বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের মল সাধারণত নরম অনেকটা ডায়রিয়ার মত দেখতে হয়। মিকোনিয়াম এমনিওটিক ফ্লুইড, মিউকাস, এবং মায়ের জরায়ুতে হজম করা অন্যান্য পদার্থের সমন্বয়ে তৈরি বলে এতে তেমন কোন গন্ধ থাকেনা। বাচ্চার বয়স ২-৪ দিন হওয়ার পর তার মলের রঙ হালকা হয়ে সবুজ রঙ ধারন করে এবং তাতে আঠালোভাব কমে আসে। এর অর্থ হলো বাচ্চা মায়ের দুধ বা ফর্মুলা হজম করা শুরু করেছে এবং তার পরিপাকতন্ত্র ঠিকঠাক মত কাজ করছে।
বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চার স্বাভাবিক পায়খানা
যদি বাচ্চা শুধুমাত্র বুকের দুধ খায় তবে তার মল হলুদ বা হালকা সবুজ এবং নরম ও আঠালোভাব থাকবে। তা ডায়রিয়ার মত পাতলা হবে এবং তাতে বীচির মত কণা থাকবে এবং পায়খানা তেমন বেশী গন্ধযুক্ত হবেনা। বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চার মল বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে যদি এর সাথে বাচ্চার আর কোন উপসর্গ দেখা না যায় তবে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
বুকের দুধ থেকে বাচ্চা কম ক্যালোরি পেলে
যদি বাচ্চার মল উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের বা ফেনার মত হয়, অনেকটা শ্যাওলার মত, তবে ধরে নেয়া যায় বাচ্চা “ফোর মিল্ক” বেশী পাচ্ছে এবং হাইন্ড মিল্ক কম পাচ্ছে। ফোর মিল্ক হলো মায়ের বুকের দুধের যে অংশ বাচ্চা প্রথমে পায়। এর মানে হলো বাচ্চাকে এক স্তন থেকে বেশী সময় ধরে খাওয়ানো হচ্ছেনা। এর প্রতিকারের জন্য একটি স্তন শেষ করে তারপর বাচ্চাকে অন্য স্তন থেকে দুধ খাওয়ান।
বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় যে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা উচিত সে সম্পর্কে জেনে নিন।
ফর্মুলা খাওয়ানো বাচ্চার স্বাভাবিক পায়খানা
ফর্মুলা খাওয়ানো নবজাতকের পায়খানা অনেকটা পেস্টের মত হয়, অনেকটা পিনাট বাটারের মত। তার মলে বাদামী বর্ণের আভা থাকবে এবং বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের পায়খানার চাইতে বেশী গন্ধযুক্ত হবে।
সলিড খাওয়ানো বাচ্চার পায়খানা
বাচ্চা যদি বুকের দুধ খায় তবে তাকে সলিড শুরু করার সাথে সাথে তার পায়খানার পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন। সলিড খাওয়ানো বাচ্চার পায়খানা বাদামী বা গাঁড় বাদামী বর্ণের, নরম কিন্তু ঘন হয়। এবং এর গন্ধ ও বেশী থাকে।
সলিড খাওয়ানো বাচ্চার মলে মাঝে মাঝে সলিড খাবারের ছোট ছোট টুকরো থাকতে পারে। এতে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। এর মানে হলো বাচ্চার সব খাবার হয়তো ঠিক মত হজম হয়নি। তবে যদি বাচ্চার পায়খানাতে নিয়মিত এ ধরনের সলিড খাবার বের হতে থাকে তবে ডাক্তার দেখিয়ে নেয়া উচিত।
ডায়রিয়া
নবজাতকের ডায়রিয়া হলে পায়খানা অনেক পাতলা হয়ে যায় এবং এতে পানির পরিমান বেশী থাকে। মলের রং হলুদ, সবুজ বা বাদামী বর্ণের হতে পারে। ডায়রিয়া সাধারনত ইনফেকশনের বা অ্যালার্জির লক্ষন হতে পারে এবং যদি কয়েকদিন ধরে চলতে থাকে তবে বাচ্চার পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। বাচ্চা যদি ৩ মাস বা তার চাইতে কম বয়সী হয় তবে বাচ্চা দিনে দুই থেকে তিনবার পাতলা পায়খানা করলে বা পাতলা পায়খানা ২ থেকে ৩ দিন থাকলে দেরী না করে ডাক্তারকে জানান। যদি বাচ্চার ডায়রিয়ার সাথে রক্ত বা মিউকাস দেখেন সে ক্ষেত্রেও দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে হবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য
আপনার শিশুর প্রথম কয়েক সপ্তাহে, মলত্যাগের রুটিন তৈরী হতে কিছুটা সময় লাগবে৷ একদিন হয়ত পায়খানা পাতলা হবে, আবার পরের দিন শক্ত হবে৷ কোনটা স্বাভাবিক আপনি শীঘ্রই বুঝতে পারবেন৷ যতদিন আপনার শিশু শুধুই বুকের দুধ খাবে, তার মল নরম থাকবে ও মলত্যাগ সহজ হবে৷ যখন ও শক্ত খাবার খেতে শুরু করে, তখন কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে, হয়ত তার মল শক্ত হয়ে উঠবে, মলত্যাগ করতে কষ্ট হবে ও সাধারণত যতবার পায়খানা হত ততবার হবে না৷
কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণগুলি সহজেই বোঝা যায়৷ যদি পায়খানা করতে গিয়ে আপনার শিশু কান্নাকাটি করে, সেটা একটা লক্ষণ হতে পারে৷ আপনি এটাও লক্ষ্য করতে পারেন যে তার মল শুকনো ও শক্ত৷ সে স্বাভাবিকের তুলনায় কম পায়খানা করতে পারে, কখনো কখনো সারা সপ্তাহে মাত্র ৩ বার পায়খানা করতে পারে৷মল ও গ্যাসে দুর্গন্ধ হলে সেগুলিও কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ৷ আরেকটা লক্ষণ হল পেট শক্ত হয়ে, ফুলে যাওয়া৷ কোষ্ঠকাঠিন্যের সময় পায়খানার সাথে হালকা রক্তও দেখা যেতে পারে।
কখনো কখনো খুব তরল পায়খানাও কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ হয়৷ যে শক্ত মল পাচন তন্ত্রে বাধা সৃষ্টি করে তার চারপাশ দিয়ে তরল পায়খানা বেড়িয়ে আসতে পারে৷ যদি আপনার মনে হয় আপনার শিশুর এইরকম কিছু হয়েছে, তাহলে ডাক্তার দেখান৷
মিউকাস সমৃদ্ধ মল
যদি বাচ্চার পায়খানাতে উজ্জ্বল, পিচ্ছিল ধরনের তন্তু দেখা যায় তবে সেগুলা মিউকাস। এর সাথে যদি আর কোন লক্ষন থাকে এবং দুই দিনের বেশী এমন দেখা যায় তবে ডাক্তারকে জানাতে হবে।
উজ্জ্বল লাল বর্ণের রক্ত যুক্ত পায়খানা
পায়খানার সাথে উজ্জ্বল লাল বর্ণের রক্তও বিভিন্ন কারনে দেখা যেতে পারে-
যদি স্বাভাবিক পায়খানার সাথে উজ্জ্বল লাল বর্ণের রক্তের ধারা থাকে তবে তা মিল্ক প্রোটিন অ্যালার্জির লক্ষন হতে পারে। আর যদি শক্ত পায়খানার সাথে দেখা যায় তবে তা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারনে মলদ্বার আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার কারনে হতে পারে। যদি ডায়রিয়ার সাথে লাল রক্ত মিশ্রিত থাকে তবে ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশনের লক্ষন হতে পারে। এ সব লক্ষন দেখা দিলে ডাক্তার দেখানো উচিত।
গাঢ় বর্ণের কালচে রক্তযুক্ত পায়খানা
মাঝে মাঝে বাচ্চার পায়খানার সাথে গাঢ় কালচে বর্ণের রক্ত আসতে পারে। এগুলো দেখতে কণার মত অনেকটা পপি বীচির মত দেখতে হয়। এটা সাধারানত বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হতে পারে। কারনে মায়ের দুধ খাওয়ার সময় মায়ের নিপল থেকে রক্ত ঝরলে তা বাচ্চার পেটে গিয়ে হজম হয়ে যেতে পারে এবং পরবর্তীতে মলের সাথে বেরিয়ে আসতে পারে। এ ধরনের কিছু হলে বাচ্চার কোন ক্ষতি হয় না। তারপরও ডাক্তার দেখিয়ে নেয়া উচিত যাতে বাচ্চার পরিপাকতন্ত্রে কোন সমস্যা আছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেয়া যায়।
কখন অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে ?
নবজাতকের পায়খানা যদি স্বাভাবিকের চাইতে ভিন্ন কিছু দেখেন সে ক্ষেত্রে ডাক্তারকে জানাতে হবে। এটাই নিয়ম।
নবজাতকের পায়খানা যদি কালো, আলকাতরার মত, ঘন, কম আঠালো এবং হজম হওয়া কালো বর্ণের রক্তের পরিমান বেশী থাকে তবে তা মেলেনার (melena) লক্ষন হতে পারে।বাচ্চাকে আয়রন সাপ্লিমেন্ট দেয়া হলেও বাচ্চার পায়খানা কালো হয়ে যেতে পারে। তবে যদি আয়রন সাপ্লিমেন্ট দেয়া না হয় তবে দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে হবে।
অনেক বেশী রক্তযুক্ত পায়খানা যা currant jelly poop নামে পরিচিত তা পরিপাকতন্ত্রের কোন জটিল সমস্যার কারনে হতে পারে।
এধরণের সমস্যাগুলো সাধারণত খুব বেশী একটা দেখা যায়না। তারপরও যদি দেখা যায় তবে দেরী না করে ডাক্তারকে জানাতে হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন