দেড় কোটি ঢাকাবাসীর টয়লেট ৬৯
প্রস্রাব-পায়খানার বেগ চেপে রাখা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এটা সবাই জানে। কিন্তু রাজধানীতে কোনো কাজে বের হলে এই অস্বাস্থ্যকর অস্বস্তিটা চেপে রাখার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই বের হতে হবে। কারণ আশেপাশে খুঁজেও কোনো শৌচাগার পাবেন না। আর যদি পানও তো দুর্গন্ধে এমনিতেই বেগ উধাও হয়ে যাবে! এই দুর্ভোগ পরিস্থিতিটা আরো পরিষ্কার হবে নিচের পরিসংখ্যানটা দেখলে।
প্রায় দেড়কোটি রাজধানীবাসীর জন্য গণশৌচাগার (পাবলিক টয়লেট) রয়েছে মাত্র ৬৯টি। সে হিসেবে প্রতি সোয়া দুই লাখ লাখ মানুষের জন্য গড়ে একটি করে শৌচাগার! সংখ্যার দিক থেকেই শুধু অপ্রতুল নয়, এসব শৌচাগারের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখলে গা গুলিয়ে উঠবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন এসব শৌচাগারগুলো নিতান্ত বিপদে পড়ে মানুষ ব্যবহার করেন। তাও শুধু পুরুষ পথচারীরা, এগুলো নারীদের জন্য ব্যবহার উপযোগী নয়।
তবে রাজধানীর গণশৌচাগারের অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করলেও নোংরা পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা, বেশি টাকা আদায়সহ নানা অভিযোগ অস্বীকার করছে ডিসিসি (দক্ষিণ)। কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব শৌচাগার যথেষ্ট ভালোভাবে চলছে। পরিবেশও অনেক উন্নত। ২০১১ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রায় ১ কোটি ৪৩ লাখ মানুষ বসবাস করে। বর্তমানে এর সংখ্যা দেড়কোটি ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ কাজের তাগিদে বাড়ি থেকে বের হয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের প্রয়োজনে অস্থায়ীভাবে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষ রাজধানীতে আসে।
এখানে বসবাসরত মানুষের জন্য নিজস্ব পরিসরে শৌচাগারের মোটামুটি ব্যবস্থা থাকলেও ভাসমান মানুষের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে কাজের সন্ধান কিংবা জীবিকা নির্বাহে অধিকাংশ সময় নগরবাসীকে ঘরের বাইরে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে হয়। এসব মানুষের স্বাভাবিকভাবেই শৌচাগার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু জনসমাগমস্থলগুলোতে চাহিদার তুলনায় শৌচাগার নেই। যাও আছে তার অধিকাংশই নোংরা, অস্বাস্থ্যকর ও ব্যবহার অনুপযোগী। ফলে অনেক পথচারী যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে বিভিন্ন রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে।
মলমূত্রের জীবাণুর কারণে দূষণের ফলে খুব সহজেই মানুষ পানিবাহিত রোগ, জন্ডিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়। যার প্রভাব পড়ে জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি গড়ে প্রতিদিন ৫ বার টয়লেট ব্যবহার করেন। রাজধানী ঢাকায় সিটি করপোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মোট ৬৯টি পাবলিক টয়লেট রয়েছে, এর মধ্যে ৪৭টি দক্ষিণের। যার মধ্যে ৫টি মোটামুটি ব্যবহার উপযোগী। ২টি ভেঙে ফেলা হয়েছে। ১০টি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। ১০টিতে কোনো সেবা নেই। এর মধ্যে ৭৫ ভাগ শৌচাগারে মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। ৫০ ভাগ টয়লেটে নিয়মিত পানি থাকে না। ৭০ ভাগে প্রয়োনীয় আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সমাজ কল্যাণ অফিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলামেইলকে বলেন, ‘৫টি আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে ডিএসসিসির গণ শৌচাগারগুলো চলছে। তবে এগুলো মধ্যে অধিকাংশের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। বেদখলে রয়েছে কয়েকটি। আবার অনেকগুলো ইজারা না দিয়ে সিটি করপোরেশন নিজেই তদারকি করছে।’
অভিযোগ রয়েছে, গণ শৌচাগারগুলোতে ব্যবহারকারীদের থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী পায়খানার জন্য ৩ টাকা এবং প্রস্রাবের জন্য ২টাকা করে আদায় করার কথা। কিন্তু উভয়টির জন্য আদায় করা হচ্ছে ৫ টাকা করে।
ওসমানী উদ্যানের শৌচাগারে প্রস্রাব করতে আসা আনছার উল্যাহ বলেন, ‘বাধ্য হয়েই এখানে প্রস্রাব করতে এসেছি। দুর্গন্ধে বসা যায় না। নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই। প্রস্রাবের জন্য ৫ টাকা দিতে হয়েছে। ভেতরে কোনো সাবান বা তোয়ালের ব্যবস্থা নেই।’
ওই শৌচাগারের তত্ত্বাবধায়ক তাজুল ইসলাম জানান, তার তত্ত্বাবধানে থাকা শৌচাগারটি সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গত বছর এটি ইজারা দেয়া হলেও এ বছর দেয়া হয়নি। দিনে তিনি খণ্ডকালীন ডিউটি করে যে কয়টাকা পান তা দিয়েই তার পরিবার চলে।
সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর গণশৌচাগারগুলোর মধ্যে ৪৭টি শৌচাগার চালু আছে। আর মাত্র দুটিতে নারী কর্মী আছেন। বাকিগুলোতে নারী কর্মী না থাকায় নারীরা সেখানে যান না।
এ বিষয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (দক্ষিণ) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘জনসংখ্যার তুলনায় যে কয়টি গণশৌচাগার রয়েছে তা একেবারেই অপর্যাপ্ত। এজন্য আরো বেশি গণশৌচাগার স্থাপন ও হাতছাড়া শৌচাগারগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন।’
তিনি শৌচাগারগুলোর সার্বিক পরিবেশ সম্পর্কে বলেন, ‘জনসাধারণের তুলনায় শৌচাগার কম ও যথাযথ তদারকি না হওয়ায় এগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এর পরেও যে কয়টি রয়েছে এগুলোকে নারীদের ব্যবহার উপযোগী করে পরিচ্ছন্ন রাখলে রোগজীবাণু ছড়াবে না।’
সিরাজুল ইসলাম আরো জানান, পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় তারা নতুন করে কোনো গণশৌচাগার নির্মাণ করতে পারছেন না। কিছু কিছু স্থানে জায়গা পাওয়া গেলেও সেখানে শৌচাগারের চাহিদা নেই।
২০১২ সালে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০ সালে বাংলাদেশের ৫৬ ভাগ জনসাধারণ স্যানিটেশন সুবিধা ভোগ করছে। এর মধ্যে ৫৭ ভাগ নগর এলাকায় এবং ৫৫ ভাগ গ্রামাঞ্চলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের ২০১২ সালের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৮১ ভাগ স্যানিটেশন কাভারেজের নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ৯৬ ভাগ মানুষ ল্যাট্রিন ব্যবহার করছে, যার মধ্যে ৮১ ভাগ স্বাস্থ্যসম্মত। ৮১ ভাগের মধ্যে ৫৬ ভাগ ব্যবহার করে একক পরিবার এবং বাকি ২৫ ভাগ ব্যবহৃত হয় সম্মিলিতভাবে। ঢাকা মহানগরীতে স্যানিটেশন কাভারেজ ৯০ ভাগ।
প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য স্যানিটেশনের প্রতি ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হলেও এ বিষয়ে নজর নেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের।
ডিএসসিসির সম্পত্তি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, নিয়মিত পরিষ্কার করা, ব্লিচিং পাউডার ছিটানো, হাত ধোয়ার সাবান সরবরাহসহ আরও কিছু শর্তে বার্ষিক চুক্তিতে শৌচাগারগুলো ইজারা দেয়া হয়। চুক্তিতে নারীদের ব্যবহারোপযোগী রাখার কথাও বলা আছে। কিন্তু ইজারাদারের ওপর নজর রাখার দায়িত্ব কার, সে প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি এ অফিসটি থেকে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর অধিকাংশ শৌচাগারগুলোর পরিবেশ নাজুক। এগুলোর কোনেটিতেই হাত ধোয়ার সাবান নেই। পরিবেশ নোংরা তার সাথে দেয়ালে অশ্লীল অশ্রাব্য লেখার ছঢ়াছড়ি। ভেতরের দেয়ালে নানা রকম অশ্লীল বাক্য, ছবি আঁকা ও সাথে মোবাইল নম্বর জুড়ে দেয়া হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে দেয়া হয়েছে কু-প্রস্তাবও।
এ বিষয়ে পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বাংলামেইলকে বলেন, ‘শৌচাগারের অভাবে দেড়কোটি ঢাকাবাসী যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করছেন। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই। পরিকল্পনা মোতাবেক এগুলে সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব।’
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পরিবেশবাদী সংগঠন পবা বেশকিছু সুপারিশ দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে- পাবলিক টয়লেট বিষয়ক সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন, জনবহুল ও গুত্বপূর্ণস্থানে নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীবান্ধব পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপন এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, জনসচেতনতা, জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোবাইল টয়লেট বসানো; নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রাখার শর্তে পাবলিক টয়লেটগুলো ইজারা দেয়া; হাটবাজার ইজারার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
Leave a comment
You must be logged in to post a comment.