চাকরির দায়ে দৈনিক পর্নোগ্রাফি দেখতে হয় যাদের
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুক সম্প্রতি তাদের কনটেন্ট মডারেশনের নীতিমালা প্রকাশ করার পর তাদের যে কর্মীরা এসব মেটেরিয়াল রিভিউয়ের কঠিন কাজটা করে থাকেন, তাদের ভূমিকা সামনে এসেছে।
সারাহ কাট্জ নামে ফেসবুকের এমনই এক সাবেক কর্মী জানিয়েছেন, ইন্টারনেটে পাওয়া যায় এমন সব ধরনের কদর্যতম জিনিস তাকে এই চাকরিতে রোজ দেখতে হতো, যার বেশিটাই পর্নোগ্রাফি- আর এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল তার ব্যক্তিগত জীবনে।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, তারা তাদের মডারেটরদের মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য দিতে সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা রেখেছে।
আসলে ফেসবুকে কাজ করেন এমন বেশকিছু কর্মী, রোজ যারা ইন্টারনেটের কুৎসিততম জিনিসগুলো দেখেন, যাতে আমার আপনার মতো সাধারণ লোকের সেগুলো দেখতে না-হয়।
ফেসবুকে কিছু আপত্তিকর চোখে পড়লে আপনি যদি সেটা রিপোর্ট করেন, তাহলে সেই অনুরোধ চলে আসে বার্লিনে ফেসবুকের এক লুকোনো অফিসে।
আর সেখানে বসেই তাদের কনটেন্ট রিভিউয়াররা প্রতিদিন হাজার হাজার ছবি আর ভিডিও দেখে যাচাই করেন, সেগুলো ফেসবুকে রাখার উপযুক্ত কি না! কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে।
ওই অফিসে কাজ করতেন, এমন এক কর্মী বলেন, আমাকে রোজ কাঁদতে হতো। ফেসবুকে বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটা, আর সবচেয়ে খারাপও, কিন্তু কারও যেন সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
তিনি বলেন, রোজ অসম্ভব সব খারাপ ও যন্ত্রণাদায়ক জিনিস দেখতে হতো … মাথা কেটে ফেলা, চাইল্ড পর্নোগ্রাফি, পশুদের ওপর নির্যাতন এসব। একটা যেন যন্ত্রের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ওগুলো দেখে আঙুলের একটা ক্লিকে ঠিক করতে হতো জিনিসটা থাকবে কি থাকবে না।
কিন্তু ফেসবুকে ওই কাজ করতে গিয়ে তাকে সবচেয়ে খারাপ জিনিস কী দেখতে হয়েছিল?
সারা কাটজের বলতে দ্বিধা নেই, চাইল্ড পর্নোগ্রাফিটাই সবচেয়ে খারাপ। কারণ ছয় মাসের শিশুকে ধর্ষণ করার দৃশ্যও দেখতে হয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাসবাদও আছে। জঙ্গি হামলা ও নৃশংসতার বহু রক্তাক্ত ঘটনাও দেখতে হয়েছে।
যে ফেসবুক কর্মীদের এই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তাদের জন্য কর্তৃপক্ষ কী করছেন? ফেসবুক প্রোডাক্ট পলিসির প্রধান মনিকা বিকার্টের কাছে এই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল।
তিনি জানান, কাজটা কঠিন কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমি বলব রিভিউয়াররা যে ধরনের জিনিসপত্র দেখেন, এই ধরনের গ্রাফিক কনটেন্ট তার খুবই সামান্য একটা অংশ। আর ক্রমশ আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছি, যাতে কেউ ফেসবুকে এই ধরনের জিনিস আপলোড করলে তা যাতে নিজে থেকেই রিভিউ করে সরিয়ে দেয়া যায়।
সারা কাটজ অবশ্য বলছিলেন, এই কনটেন্ট রিভিউয়ের কাজ তার মানসিক সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার ওপরেও সাংঘাতিক প্রভাব ফেলেছিল।
তার কথায়, বেশ কয়েকবার আমি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছি। একবার তো দেখেছিলাম একটা উঁচু বিল্ডিং থেকে কেন জানি না লোকজন লাফিয়ে পড়ছে, আর তাদের বাঁচানোর বদলে লোকজন ছবি তুলছে, ভিডিও করছে।
তিনি বলেন, আমি একটা বাচ্চা মেয়েকে ধরে ফেললাম, কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙে গেল … চারদিকে রক্ত, তবু কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না- শুধু ভিডিও তুলে যাচ্ছে!
এমনকি তিনি বলছেন, এই গভীর মানসিক সংকটের সময় ফেসবুকও তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।
তিনি আরও বলেন, কোম্পানি আমাদের কোনও সাহায্যই করেনি। আমরা প্রায় রোজ অভিযোগ জানাতাম। প্রায় রোজই, কারণ আমাদের খুব সমস্যা হচ্ছিল। আমাদের যে জিনিসগুলো দেখতে হতো সেগুলো আর নেয়া যাচ্ছিল না।
ফেসবুক অবশ্য দাবি করছে এই কর্মীদের সাহায্য করা হয় না, সেই অভিযোগ মোটেও ঠিক নয়।
মনিকা বিকার্ট বলেন, কাজটা কঠিন ঠিকই- কিন্তু সেটা ঠিকমতো করার জন্য যা দরকার কর্মীদের সেটা দিতেও কিন্তু আমরা দায়বদ্ধ।
তিনি বলেন, তারা যদি কাজে কখনও অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়- অন্য ধরনের কনটেন্টের কাজেও তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। ফেসবুক কমিউনিটিকে যেমন, তেমনি আমাদের কর্মীদেরও নিরাপদ ও সুস্থ রাখাটা কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সারা কাটজ বহুদিন ভেবেছেন, ফেসবুকের কর্ণধার যদি তাদের অফিসে কখনও পা রাখেন, তিনি তাকে সোজা জিজ্ঞেস করবেন আমাদের মতো ছেলেমেয়েদের কেন এই সব দেখতে আপনি বাধ্য করছেন? আমরা কি মানুষ নই?
Leave a comment
You must be logged in to post a comment.